মহাপরিচালকের কথা
রাব্বুল আলামীন মহান আল্লাহর প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা) সর্বকালের সমগ্র মানবগোষ্ঠীর জন্য সর্বোত্তম আদর্শ, শ্রেষ্ঠতম পথ প্রদর্শক। তাঁর অনুকরণ ও অনুসরণের মধ্যেই নিহিত আছে ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের শান্তি, কল্যাণ ও নাজাতের নিশ্চয়তা। তিনি দীন ইসলামের জীবন্ত প্রতীক। তাঁর পবিত্র জীবন কুরআন পাকেরই বাস্তব রূপ। ইসলামী জীবন গঠনের জন্য তাই তাঁর সীরাত সম্পর্কিত জ্ঞান আহরণ অপরিহার্য। এ গুরুত্ব অনুধাবন থেকেই যুগে যুগে দেশে দেশে বিভিন্ন ভাষায় রচিত ও সংকলিত হয়েছে অসংখ্য সীরাত গ্রন্থ।
• আবূ-মুহাম্মদ আব্দুল মালিক ইবন হিশাম মুআফিরী (র) (মৃত্যু ২১৮ হি.) সীরাত শাস্ত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পথিকৃৎ। তাঁর সংকলিত ‘সীরাতুন নববিয়্যাহ’ সংক্ষেপে ‘সীরাতে ইবন হিশাম’ সুপ্রাচীন, মৌলিক, নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ যার ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে বাংলাভাষীদের সামনে এ অমূল্য গ্রন্থের তরজমা পেশ করতে পেরে আমরা আনন্দিত ও গর্বিত।
• সীরাতে ইব্ন হিশাম মূলত আল্লামা ইবন ইসহাকের সর্বাধিক প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ‘সীরাত ইবন ইসহাক’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। আল্লামা ইবন ইসহাক এ গ্রন্থ প্রণয়ন করেন আব্বাসী খলীফা মামুনের শাসনামলে। এতে রয়েছে হযরত আদম (আ) থেকে শেষনবী হযরত মুহাম্মদ (সা) পর্যন্ত বিস্তারিত বর্ণনা। এর মধ্যে থেকে ইব্ন হিশাম তাঁর গ্রন্থে সংকলন করেছেন হযরত ইসমাঈল (আ) থেকে হযরত হযরত মুহাম্মদ (সা) পর্যন্ত ঘটনাবলী।
-চারখণ্ডে সমাপ্ত এ-সীরাত গ্রন্থখানি ১৯৯৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। মুদ্রিত সমুদয় কপি নিঃশেষ হওয়ায় বর্তমানে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করা হলো। সংশোধিত ও পুনঃসম্পাদনাকৃত এ সংস্করণটিও সুধী পাঠকমহলের নিকট সমাদৃত হবে বলে আমরা আশাবাদী। আমরা এ গ্রন্থের সাথে সংশ্লিষ্ট অনুবাদকবৃন্দ, সম্পাকমণ্ডলী, অনুবাদ ও সংকলন বিভাগের সহকর্মিগণকে আন্তরিক মুবারকবাদ জানাই।
মহান আল্লাহ্ এ মহতী কাজে আমাদের সবার খিদমত কবুল করুন। আমীন!
মোঃ ফজলুর রহমান
মহাপরিচালক
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
প্রকাশকের কথা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার জন্য। সালাত ও সালাম তাঁর প্রিয় হাবীব সায়্যিদুল মুরসালীনের প্রতি। নবী করীম (সা)-এর কর্মময় জীবনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ভাষায় বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। কেবল উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যেই নয়, অমুসলিম লেখক ও গবেষকদের মধ্যেও অনেকেই নবীজীবনী রচনায় আত্মনিয়োগ করেছেন। দুনিয়ার বুকে যতদিন মানব সন্তানের অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন সীরাত চর্চাও অব্যাহত থাকবে।
সীরাত গ্রন্থের মধ্যে ইব্ন হিশাম রচিত ‘সীরাতুন্নবী’ একটি বুনিয়াদী গ্রন্থ। সর্বজন সমাদৃত এ গ্রন্থকে অনুসরণ করেই পরববর্তীকালে সীরাত গ্রন্থসমূহ রচিত হয়েছে। বিভিন্ন ভাষায় পুস্তকটি অনূদিত হলেও ১৪১৫ হি. উদযাপন উপলক্ষে ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলা ভাষায় এটি প্রথম প্রকাশিত হয়।
চার খণ্ডে সমাপ্ত সীরাতের এ প্রাচীনতম গ্রন্থটির বাংলা সংস্করণ ব্যাপক পাঠক চাহিদার দরুন অল্পদিনেই নিঃশেষ হয়ে যায়। এক্ষণে সংশোধিত ও পরিমার্জিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করা হলো। এ সংস্করণ প্রকাশের পূর্বে প্রথম খণ্ডটি পুনঃ সম্পাদনা করা হয়েছে। সম্পাদনা করেছেন বাংলাদেশ মাদ্রাসা বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোঃ আবদুল মান্নান এবং প্রুফ সংশোধন করেছেন জনাব কালাম আযাদ। আশা করি প্রথম সংস্করণের মত সীরাতুন্নবী (সা)-এর দ্বিতীয় সংস্করণটিও সুধী পাঠকবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হবে।
এ সংস্করণেও পুস্তকটি নির্ভুল করার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। তা সত্ত্বেও বিজ্ঞ পাঠকের চোখে যদি এতে কোন প্রকার ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়, মেহেরবানী করে আমাদের অবহিত করলে ইনশাআল্লাহ্ পরবর্তী সংস্করণে আমরা তা সংশোধন করে নেব!
পুস্তকটির অনুবাদ, সম্পাদনা এবং প্রকাশের ক্ষেত্রে যাঁরা সহযোগিতা দিয়েছেন তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আল্লাহ্ পাক আমাদের এ শ্রমকে ইবাদত হিসাবে কবুল করুন। আমীন! ইয়া রাব্বাল আলামীন!
মুহাম্মাদ শামসুল হক
পরিচালক অনুবাদ ও সংকলন বিভাগ
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
সম্পাদনা পরিষদের বক্তব্য
সম্পাদনা পরিষদের বক্তব্য
সীরাত গ্রন্থ রচনার মূল প্রেরণা হলো রাহমাতুল্-লিল আলামীন খাতামুন-নাবিয়্যীন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম-এর হুবহু অনুসরণের মাধ্যমে নিজের ব্যবহারিক জীবনকে সুমহান আদর্শের অনুসরণে গড়ে তোলার সুযোগ লাভ করা, ঈমান সতেজ ও সরস করা, দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্য লাভ করা।
বিশ্বপালক আল্লাহ তা’আলা তাঁর হাবীব মুস্তফা (সা)-এর সুমহান চরিত্রের প্রশংসা করে পাক কুরআন মজীদের সূরা ‘কালামের’ চতুর্থ আয়াতে ইরশাদ করেন : وَأَنَّكَ لعَلَى خُلق عظيم “নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চারিত্রের উপর অধিষ্ঠিত।” সূরা আহযাবের ২১ নং আয়াতে ইরশাদ – لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولُ الله أَسْوَةٌ حَسَنَةٌ : নিশ্চই রাসুলুল্লাহ মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।”
আমাদের প্রতিপালক তাঁর রাসূলে পাকের সুমহান চরিত্রের মধ্যে আমাদের ইহ-পরকালীন সার্বিক সাফল্যের জন্যে উত্তম আদর্শ রেখেছেন। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই আমাদেরকে এ সুমহান চরিত্র ও উত্তম আদর্শের হুবহু অনুসরণ করা দরকার। পাক কুরআন মজীদ ও রাসূলে করীম (সা)-এর সুন্নাহই হলো সে সুমহান চরিত্র ও উত্তম আদর্শের আক্ষরিক রূপ। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহকে সকল মানুষের সামনে সহজে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্যই সীরাত গ্রন্থ রচিত হয়েছে।
আজকাল বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরেই মানুষ সবকিছু যাচাই করতে চায়। কিন্তু বিজ্ঞানের আনাগোনা শুধু মাটি, পানি, আগুন ও বাতাস নিয়ে। অর্থাৎ বস্তুজগত নিয়ে বিজ্ঞানের খেলা। কিন্তু মানুষ তো বস্তুজগতের একটি অংশ তথা কেবল দেহসর্বস্বই নয়, মানুষের যে আত্মা আছে। দেহ আর আত্মা এক নয়। দেহ জড় ও স্কুল, আর আত্মা সূক্ষ্ম ও অজড়। দেহ ক্ষণস্থায়ী, পরিবর্তনশীল। আত্মা চিরস্থায়ী, অপরিবর্তনীয়, বিরাট-বিশাল। আত্মা মহাসত্য। に
মওত, কবর, মীযান, হাশর, পুলসিরাত, জান্নাত-জাহান্নাম, ফেরেশতা, আমলনামা, আরশ- কুরসী, লওহ-কলম ইত্যাদির কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। এসব বিজ্ঞানের ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ এসবই মহাসত্য।
সমগ্র সৃষ্টিই মহান আল্লাহ্। সৃষ্টি জগতের এক কণার রহস্যও এখনো উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। যে বিজ্ঞান সৃষ্টিকর্তার বিশাল সৃষ্টি জগতের এক কণার রহস্যও উদঘাটন করতে পারেনি, তা কি করে বিশ্বস্রষ্টা বিশ্বপালক মহান আল্লাহর সত্তাকে যন্ত্রের মাধ্যমে ধরে ফেলবে! পরম গৌরবান্বিত মহিমান্বিত আল্লাহ্ মানব কল্পনার অতীত, চিন্তা ও ধারণা সেখানে অবশ, জ্ঞান ও রূপের বাইরে। চিন্তালোকের শেষ সীমা পর্যন্ত বিচার করার শক্তি মানুষের নেই। মানুষের চিন্তা, জ্ঞান ও গবেষণা যেখানে যেয়ে অবশ হয়ে যায়, সেখানেই চিন্তালোকের শেষ নয়। পাক কুরআন মজীদ যে চিন্তালোকের দ্বার খুলে দিয়েছে, জড় বিজ্ঞান সেখানে অবোধ শিশুর ন্যায় এবং কিয়ামত পর্যন্ত এ হীন অবস্থা কাটিয়ে ওঠার সুযোগ তার নেই।
এক শ্রেণীর লোক জড়বাদের ক্ষণস্থায়ী ও কৃত্রিম মোহে অন্ধ হয়ে মহান অস্তিত্বে সংশয়, পবিত্র কুরআন-সুন্নাহর প্রতি অভক্তি ও অবিশ্বাস করে ইসলাম ও ঈমানের মূলে কুঠারাঘাত
করছে। তারা বলে, বর্তমান সভ্য দুনিয়ার জন্য ইসলাম নয়; যুগের ভাবধারার সাথে ইসলামেরও পরিবর্তন হওয়া দরকার। এ যুগে নামায-রোযা ও পর্দা অচল। তাদের মতে নাচগান, মদ- জুয়া, ব্যভিচার ইত্যাদিতেই জীবন। কাজেই ইসলাম জীবনের পরিপন্থি।
আমাদের মতে, তাঁরা ইতিহাসের অবমাননা করেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইবাদতের মাধ্যমেই মানবজীবনের সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব। তাতেই ইহ-পরকালের মুক্তি নিহিত। আর এ সত্যের সন্ধান দিয়েছে ইসলাম। ইসলাম বিশ্বস্রষ্টা বিশ্বপালক আল্লাহ তা’আলার মনোনীত একমাত্র দীন। সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা)-এর মাধ্যমেই ইসলাম জগতে প্রচারিত হয়েছে। সকল পূর্ণতা তাঁর মধ্যে এসে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। যে তাঁকে মানবে, পথ পাবে, যে অমান্য করবে, সে পথভ্রষ্ট হবে। তাঁরই মুবারক জীবনী আলোচিত হয়েছে এ সীরাত গ্রন্থে। কাজেই এ সীরাত গ্রন্থ পাঠ করা সকলের অবশ্য কর্তব্য।
মানুষের জ্ঞান সীমাবদ্ধ। বৈজ্ঞানিক কিংবা দার্শনিক কেউই জানে না, আগামী দিন সে কোথায় থাকবে, কি আহার করবে, কবে ও কোথায় তার মৃত্যু ঘটবে। দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ সমস্যা সম্বন্ধেই যখন অজ্ঞতা অপরিসীম, তখন পরকালেয় অনন্ত জীবন সম্বন্ধীয় জ্ঞান কোথায় পাওয়া যাবে? নবী-রাসূল ও আসমানী কিতাব ব্যতীত পরকালের কোন স্পষ্ট ধারণাও মানুষ কল্পনায় আনতে সক্ষম হত না।
কাজেই যে নবী ও রাসূল ইহকাল ও পরকাল সম্বন্ধে সম্যক অবগত, তাঁর আদেশ- উপদেশ, কর্মধারা ও ব্যবহারিক জীবনের আদর্শের অনুসরণ ব্যতীত ইহ-পরকালীন কল্যাণ ও মঙ্গলের দ্বিতীয় পথ নেই। আর সেজন্যেই ‘সীরাতুন্নবী’ বা ‘নবী-চরিত’ অধ্যয়ন করা, সামাজিকভাবে চর্চা করা আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।
এ কর্তব্যবোধে সাড়া দিয়েই ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ইসলামের আদি যুগের প্রামাণ্য সীরাত গ্রন্থ অর্থাৎ প্রায় বারোশত বছর পূর্বের ইবন হিশাম (র) রচিত বিশ্বনন্দিত সীরাত গ্রন্থখানি বাংলা ভাষায় অনুবাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। তৎকালীন কঠিন আরবী ভাষা থেকে বাংলায় হুবহু রূপান্তরের জন্য এ দুরূহ কাজে আমাদের সম্মানিত অনুবাদকগণ সাধ্যমত চেষ্টার ত্রুটি করেননি। তাঁদের অনুবাদকর্মকে ঢেলে সাজানোর জন্য সম্পাদনা পরিষদও সচেতন থেকে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। তারপরও প্রকৃতিগত মানবিক দুর্বলতার কারণে অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যাওয়া বিচিত্র নয়। সুধী পাঠক এ ব্যাপারে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি প্রসারিত এবং পরবর্তী সংস্করণের পূর্বে সঠিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করলে আমরা সবাই উপকৃত হব।
বিশ্বস্রষ্টা বিশ্বপালক আল্লাহ গাফুরুর রাহীমের দরবারে মুনাজাত করি, তাঁর হাবীব পাকের সীরাত পাঠ করে আমরা যেন সঠিকভাবে তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারি এবং তাঁর ব্যবহারিক জীবনের আদর্শের অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখিরাতের সার্বিক সাফল্য অর্জন করতে পারি। আমীন! সুম্মা আমীন!
মুহাম্মদ ফরীদুদ্দীন আত্তার
সভাপতি